করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করার সরকারি কোনো পদক্ষেপই আলোর মুখ দেখছে না। বারবার ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরার পরও বিষয়টি উপেক্ষিত। বেশীর ভাগ মানুষ বেরুলে মাস্ক ব্যবহার করছেন না। মাস্ক সাথে থাকলেও পরছেনা অথবা পকেটে রেখে ঘোরাফেরা করছেন । অথচ আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা এখনো উৎকন্ঠার সীমানা অতিক্রম করেনি। অন্যদিকে, গবেষণায় মাস্ককে ভ্যাকসিনের চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেছেন, ‘এখন প্রশাসনের কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বর্তমানে মানুষের ভাবটা এমন-যেন করোনা বলতে কিছু নেই।’
মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছিলো করোনার ভয়াল থাবা। তারপর আর থেমে নেই। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ঈদের পূর্বে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমে আসলেও ঈদের পর থেকে আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত ২১ আগস্ট সিলেট বিভাগে আক্রান্ত হয় ১৩২ জন। গতকাল শনিবার আক্রান্ত হয়েছেন ১২১ জন। মৃতের সংখ্যাও একেবারে কমে যায়নি। গতকাল শনিবার ২জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর আগের দিন মৃত্যু হয় তিনজনের। বিশ্বের উন্নত অনেক দেশও বর্তমানে অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক দেশে লকডাউন তুলে নেয়ার পর পুনরায় সংক্রমিত হচ্ছে, মানুষ মরছে। অনেক দেশ তৃতীয় দফা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এই বাস্তবতায় সরকার মাস্ক পরার বিষয়টিকে শুরু থেকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ৬৬ দিনের ছুটি শেষে গত ৩১ মে সীমিত আকারে অফিস, গণপরিবহন চালু হয়। এরপর গত ৩০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে চলাচল নিয়ন্ত্রণের মেয়াদ ৩ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ায়। ওই প্রজ্ঞাপনে মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
২১ জুলাই ১১টি ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে পুনরায় নির্দেশনা জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। কিন্তু সরকারের কোনো নির্দেশনাই কাজে আসছে না। পথের ভিক্ষুক থেকে শুরু করে গণপরিবহনের চালক, শ্রমিক, যাত্রী, হাটবাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা, মসজিদ-মন্দির সবখানে মাস্ক ব্যবহারে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে কিছু মানুষের বেলায় ব্যতিক্রমও আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। অর্থাৎ হাটবাজার, অফিস আদালত, পথচারী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ত্রিশভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহারে অভ্যস্থ।
গতকাল শনিবার ওসমানী হাসপাতাল এর সীমানার বাইরে সুমন ও আরিফ নামে দু’জনের সাথে দেখা হয়। তারা হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের মুখে মাস্ক নেই। জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘পকেটে আছে, হাসপাতালের ভেতরে যাওয়ার পর পড়বো।’ জিন্দাবাজার এলাকায় তিনভাগের দুইভাগের মানুষের মুখে মাস্ক দেখা যায়না। আলতাফ নামের এক ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘সবসময় পড়তে ভালো লাগেনা। তবে পকেটে আছে।’
এই বাস্তবতায় গত ১০ আগস্ট সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় মাঠ প্রশাসনকে আবারো কঠোর নির্দেশ দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ থেকে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কিন্তু তবু মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাসটি টেকসই হচ্ছে না। কতোয়ালী থানা সূত্র বলছে, গত দুইমাসের মধ্যে এ ধরণের কোনো অভিযান হয়েছে বলে মনে হয়না।
গবেষক ড. সাদিকুর রহমান বলেন, ‘করোনা সহজে যাবার বিষয় নয়। এটি সব পর্যায়ের মানুষ জানেন, কিন্তু মানতে নারাজ। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস ছাড়াও মাস্ক ব্যবহার শিশু থেকে শুরু সকল বয়েসি মানুষের জন্য উপকারি। কারণ আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরণের দুষিত পদার্থ রয়েছে। যা বাতাসের সঙ্গে আমরা গ্রহণ করছি। এগুলো করোনাভাইরাস ছাড়াও বিভিন্ন অসুখের কারণ হতে পারে। বাতাসে প্রবাহিত ক্ষতিকর পদার্থের কারণে শিশুর বুদ্ধিমত্তা কমে যেতে পারে, দেখা দিতে পারে আচরণগত সমস্যা। ক্ষতিকর বাতাস থেকে নিজেকে কিছুটা রক্ষা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে মুখোশ বা মাস্ক। যা ব্যবহার করলে প্রাথমিকভাবে এসব থেকে রেহাই মিলতে পারে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন ‘বর্তমান বাস্তবতায় প্রয়োজন প্রশাসনকে কঠোর হওয়া। যারা মাস্ক ব্যবহার করেননা, তাদের ন্যূনতম জরিমানা করা। তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি যারা সমাজ সচেতন, রাজনীতিবিদ তাদেরও উচিত নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে মাঠে নামা। যেসকল মানুষ মাস্ক পরছেনা, তাদেরকে সচেতন করা। সবার সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এটি কার্যকর সম্ভব নয়। নিজেদের সদিচ্ছা থাকলে যে ভালো কিছু করা সম্ভব সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন সিলেটের নাট্যকর্মীরা, সংস্কৃতি কর্মীরা। তারা করোনার শুরু থেকে এখনো মানুষের পাশে রয়েছেন।’
ডা. তায়েফ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘মাস্ক পরা অভ্যাস হলে সুস্থ মানুষও থাকতে পারবেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন্ থাকার মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলোও চর্চা করা দরকার।’
বিশিষ্ট আইনজীবী, সিলেট স্টেশন ক্লাবের সভাপতি ই ইউ শহীদুল ইসলাম বলেন, করোনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এটি মোকাবেলা করতে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশিত বিষয়গুলোকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন তুলে নেয়ার পর আবার সংক্রমিত হবার ঘটনা ঘটছে। যেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধির অন্য যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো না মানলে অবনতি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবেনা।’
স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেছেন, ‘এখন কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা আগের তুলনায় কমতে শুরু করেছে। এখন প্রয়োজন মানুষের বেশী সচেতন হওয়া। মানুষ সচেতন না হলে আমরা আগের জায়গায় আবার ফিরে যাবো।’
বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কঠোর যেমন হতে হবে তেমনি মানবিকও হতে হবে। যারা মাস্ক পড়েনা আমরা তাদের জরিমানা করছি, একইসাথে যাদের মাস্ক কিনার সামর্থ্য নেই তাদেরকে মাস্কও কিনে দিচ্ছি।